November 11, 2024, 12:20 am
সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের দৈর্ঘ্য ১৭৯ কিলোমিটার। এই রেল সেকশনে জরাজীর্ণ হয়ে পড়া রেলপথসহ রয়েছে ১৩টি ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু। যার কারণে এই রেল সেকশনে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। বিগত ৮ মাসেই এই সেকশনে ঘটেছে অন্তত: ১১টি দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনার কারণে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ৫ জনের প্রাণহানীসহ আহত হয়েছেন অনেকেই।
সিলেটের রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট-আখাউড়া সেকশনে পূর্বে ট্রেনের গতি ছিল ৭০-৮০ কিলোমিটার কিন্তু এখন ৪০ কিলোমিটার গতিতে চালাতে হচ্ছে।
রেলওয়ের প্রকৌশল শাখা জানায়, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের অতিঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে শমশেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২শ’ নম্বর সেতু, ভানুগাছ- শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, মনতলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু, মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু।
তারা আরো জানান, এই মূহূর্তে সেতুগুলো সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় সংস্কারের কোন সম্ভাবনা নেই। এছাড়া, এই পথের অনেক স্থানেই রেল পথের স্লীপারে পাথর না থাকা এবং নাট-বল্টু চুরি যাওয়ার কারণে স্লিপার নড়াচড়া করা ইত্যাদি। ইতিপূর্বে অনেকগুলোতেই স্লিপারের নড়াচড়া বন্ধে বাঁশ দিয়ে মেরামত করা হয়েছিল।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের তথ্যমতে, আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস নামের ৬টি আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন ১২ বার চলাচল করে। প্রতিদিন সকালে সিলেট থেকে ঢাকার পথে ২টি, বিকেলে ১টি, ঢাকা থেকে সিলেটের পথে দুপুরে ১টি, সন্ধ্যায় ১টি ও রাতে ১টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। প্রতি রাতে ঢাকা-সিলেট পথে ২ দিক থেকে ২টি আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে। প্রতিদিন চট্টগ্রামের পথে দুপুরে ১টি ও রাতে ১টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। আবার ফিরতি পথে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের পথে দিনে ১টি ও রাতে ১টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এ ছাড়া, প্রতি রাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পথে ১টি করে মেইল ট্রেন চলাচল করে। তাছাড়া, আরো ১টি মেইল ট্রেন চলে। চলাচলকারী ১৫টি ট্রেনে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে থাকেন। রেলপথে যারা ভ্রমণ করেন তাদের বেশিরভাগ মানুষই রেলকে বেছে নেন নিরাপদ যাত্রার মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু বারবার যান্ত্রিক ত্রুটি ও দুর্ঘটনার কারণে রেলপথে যাতায়াত এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
আইও ডাব্লিউ কুলাউড়ার প্রকৌশলী জুয়েল আহমদ জানান, মাইজগাঁও থেকে রশীদপুর এলাকা পর্যন্ত তার তদারকির স্থান। এসব স্থানে এখন ৩টি স্থান অর্থাৎ শমসেরনগর, সাতগাঁও ও শ্রীমঙ্গলের ঝুঁকিপূর্ণ ব্রীজছাড়া সবগুলোই সংস্কার করা হয়েছে। অন্য স্থানগুলো অন্য প্রকৌশল অফিসের আওতাধীন তাই তার তথ্য আমি জানিনা।
তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকৌশল শাখার সূত্র জানান, আখাউড়া-সিলেট রেলপথের ১৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩টি সেতুই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব সেতুর ওপর ট্রেন পারাপারে ‘ডেড স্টপ’ (সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, এরপর ৫ কিলোমিটার গতিতে চলা শুরু করবে) ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৮ এর ২৯ মার্চ হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকার ৫৬ নম্বর সেতু বৃষ্টির পর মাটি সরে যায়। এতে রেল যোগাযোগ কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে। তারপর থেকে ওই সেতুটিতে ডেড স্টপ দিয়েই চালানো হচ্ছে ট্রেন।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, এই সেকশনের বেশিরভাগ সেতুই ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯ নং সেতুতে ‘ডেড স্টপ’ জারি করা হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৩ জুন রাতে এই পথের কুলাউড়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয় উপবন এক্সপ্রেস। কুলাউড়ার বরমচালে সেতু ভেঙে সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের ১টি বগি ছিটকে খাদে পড়ে। লাইনচ্যুত হয় ৪টি বগি। এ দুর্ঘটনায় ৫জন নিহত ও ৬৭ জনের মতো আহত হন। ২১ ঘণ্টা পর রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিন বিকল হয়ে শ্রীমঙ্গলে ৪ ঘণ্টার মতো আটকে থাকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস। ৫ এপ্রিল রাতে মাইজগাঁও স্টেশন এলাকায় শাহজালাল সারকারখানা থেকে সার বহনকারী বিসি স্পেশাল ট্রেনের বগিটি লাইনচ্যুত হয়ে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে। ১৬ মে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুর এলাকায় জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনের ১টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এর আগে ২০১৮ এর ২৮ মার্চ মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী তেলবাহী ১টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ ২ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। ওই বছরের ৭ এপ্রিল একদিনে ২বার দেখা দেয় যান্ত্রিক ত্রুটি। কুলাউড়ার-মাইজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে পারাবত এক্সপ্রেসের বগি ও ইঞ্জিনের সংযুক্তস্থলের বাফার রিং ভেঙে গেলে বগির সঙ্গে ইঞ্জিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে ২ ঘণ্টা আটকে থাকে পারাবত। একইদিন আবার ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস রাত সাড়ে ১১টার দিকে কুলাউড়া স্টেশনের পরবর্তী লংলা স্টেশন অতিক্রমকালে ট্রেনের বগি ও চাকার সংযুক্ত ১টি লোহার রড ভেঙে যায়। এ অবস্থায় ভাঙা রডটিসহ ট্রেনটি টিলাগাঁও, মনু স্টেশন অতিক্রম করে রাত ১২টায় শমশেরনগর স্টেশনে এসে যাত্রা বিরতি করে। একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও এলাকায় উপবন এক্সপ্রেসের বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে সিলেট-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে প্রায় ১৫ ঘণ্টা। এরইমধ্যে বেশ কয়েকবার এই রুটে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ট্রেন। যান্ত্রিক ত্রুটি, বগি লাইনচ্যুত হওয়া, বগি থেকে ইঞ্জিন খুলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।
জানা যায়, আখাউড়া- সিলেট রেল সেকশনে রেল যোগাযোগ চালু হয় ব্রিটিশ আমলে। ওই সময়ে রেলের জন্য যে লাইন নির্মাণ করা হয়, সেই পথ দিয়েই এখনও চলছে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় রেলপথ। কিন্তু এ রেলপথে বড় ধরনের কোন সংস্কার করা হয়নি। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে, তখনই সংস্কারের তোড়জোড় দেখা যায়। কিছুদিন পর তা স্থিমিত হয়ে যায়।